দ্বৈত শাসন বলতে কি বুঝায়

দ্বৈত শাসন বলতে কি বুঝায় : দ্বৈত শাসন বলতে বুঝায় একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে দুটি আলাদা শক্তি বা কর্তৃপক্ষ একসাথে শাসন পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থা মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের সময় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, ওড়িশার দেওয়ানী (রাজস্ব আদায় ও ন্যায়বিচার) কর্তৃত্ব প্রদান করেন। এর ফলে বাংলার নবাব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একসাথে বাংলার শাসন পরিচালনা করতেন, যা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত।


## দ্বৈত শাসনের প্রেক্ষাপট

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, ওড়িশার উপর তাদের প্রভাব বিস্তার শুরু করে। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে নবাব মীর কাসিম, মুঘল সম্রাট শাহ আলম, এবং আওধের নবাব সুজাউদ্দৌলা পরাজিত হন। এর পরের বছর, ১৭৬৫ সালে, মুঘল সম্রাট শাহ আলম ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যেখানে তিনি কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, ওড়িশার দেওয়ানি অধিকার প্রদান করেন। এই দেওয়ানি অধিকার ব্রিটিশদেরকে ওই প্রদেশগুলির রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেয়, যদিও নামমাত্র নবাবের শাসন ব্যবস্থা বজায় ছিল।


## দ্বৈত শাসনের গঠন

দ্বৈত শাসনে, প্রশাসনিক ক্ষমতা দুইটি কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিভক্ত ছিল। 

১. **নবাব**: নবাব সামরিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করতেন। 

২. **ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি**: কোম্পানি রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করত। 

নবাবদের প্রশাসনিক কার্যাবলীর উপর কোম্পানির সরাসরি প্রভাব ছিল, এবং কোম্পানির নিযুক্ত কর্মচারীরা প্রকৃতপক্ষে প্রশাসন পরিচালনা করতেন। নবাবদের শুধুমাত্র তাদের অবস্থান ধরে রাখতে দেয়া হতো এবং তাদের কার্যত কোনো ক্ষমতা ছিল না।

## দ্বৈত শাসনের প্রভাব

দ্বৈত শাসনের ফলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে:

১. **রাজস্ব ব্যবস্থা**: ব্রিটিশরা রাজস্ব আদায়ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার ফলে কৃষকদের উপর করের বোঝা বেড়ে যায়। ব্রিটিশরা বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য কঠোর নীতি গ্রহণ করত, যা কৃষকদের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে।

   ২. **আর্থ-সামাজিক অবনতি**: দ্বৈত শাসনের ফলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায়। অতিরিক্ত কর এবং কঠোর শাসনের কারণে অনেক কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং জমি হারিয়ে ফেলে।

৩. **প্রশাসনিক দুর্নীতি**: দ্বৈত শাসনের ফলে প্রশাসনিক দুর্নীতি বেড়ে যায়। কোম্পানির কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে কাজ করত এবং নবাবদের সহযোগিতায় বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাত।

৪. **অর্থনৈতিক শোষণ**: ব্রিটিশরা বাংলার সম্পদ শোষণ করতে থাকে, যার ফলে বাংলার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলার ঐতিহ্য হারিয়ে যায় এবং দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

৫. **বিপর্যস্ত শাসন ব্যবস্থা**: দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা কার্যত ব্যর্থ হয় এবং এটি ব্রিটিশদের উপর বাংলার জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভ বৃদ্ধি করে। বাংলার জনগণ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে।


## দ্বৈত শাসনের সমাপ্তি

১৭৭২ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে এবং সরাসরি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন এবং তিনি নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যা বাংলার প্রশাসনকে আরও কার্যকর করে তোলে। 

সর্বশেষ, দ্বৈত শাসন ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পরীক্ষা যা শেষ পর্যন্ত কার্যত ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। এই শাসন ব্যবস্থা বাংলার জনগণের উপর বিপুল প্রভাব ফেলে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভারতের ভবিষ্যত শাসন ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেয়।

  আরও পড়ুন >>> অধিকার অর্থ কি

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url