প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ : প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ (Remittance) হলো সেই অর্থ যা বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা তাদের নিজ দেশে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পাঠান। প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এটির গুরুত্ব আরও বেশি। এ প্রবন্ধে আমরা প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের সংজ্ঞা, এর গুরুত্ব, এর প্রভাব, এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।

### প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের সংজ্ঞা

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ হলো সেই টাকা বা অর্থ যা একজন ব্যক্তি তার নিজ দেশ থেকে বাইরে গিয়ে অর্জন করে এবং তা তার নিজ দেশে পাঠায়। এটি সাধারণত বিদেশে কাজ করা কর্মীদের মাধ্যমে পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ একটি বড় আয়ের উৎস। এই অর্থের মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।

### প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের গুরুত্ব

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের গুরুত্ব বহুমুখী। এটি কেবল একটি দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে না, বরং ব্যক্তিগত পর্যায়েও পরিবারগুলোর জন্য এটি একটি বড় সহায়ক। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, যা দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক।

#### ১. অর্থনীতির উন্নয়ন

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয়। এই অর্থের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আয় বাড়ে এবং দেশের জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এই অর্থ দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়, যেমনঃ সড়ক, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণে।

#### ২. বেকারত্ব কমানো

প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে কাজ করে তাদের পরিবারের জন্য একটি নিশ্চিত আয়ের উৎস তৈরি করেন। এটি দেশের অভ্যন্তরে বেকারত্বের চাপ কমাতে সহায়তা করে। প্রবাসী কর্মীরা দেশ ছাড়লে, দেশে বেকারত্বের হার কমে যায় এবং তাদের পাঠানো অর্থের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়।

#### ৩. সামাজিক উন্নয়ন

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। এতে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ, পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

### প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের প্রভাব

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের প্রভাব বিভিন্নভাবে অনুভূত হতে পারে। এটি দেশীয় অর্থনীতিতে যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও দেখা যেতে পারে।

#### ইতিবাচক প্রভাব

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ দেশের জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করে এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সহায়তা করে। এছাড়া, প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ পরিবারের সদস্যদের আর্থিক স্বাধীনতা এনে দেয় এবং তাদের জীবনের মান উন্নয়ন করে। অনেক ক্ষেত্রে এই অর্থ নতুন ব্যবসা শুরু করতে বা বিনিয়োগ করতে ব্যবহার করা হয়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয়।

#### নেতিবাচক প্রভাব

তবে, প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের কিছু নেতিবাচক প্রভাবও আছে। প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা অনেক সময় দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরা নিজেদের কর্মসংস্থানের প্রতি কম আগ্রহী হয়ে পড়তে পারে, যেহেতু তারা প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের ওপর নির্ভর করে। এছাড়া, যদি কোনো কারণে প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের প্রবাহ কমে যায়, তবে তা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

### চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ প্রেরণের প্রক্রিয়া অনেক সময় বেশ জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ হতে পারে। অনেক দেশেই অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে উচ্চ হারের ফি আদায় করা হয়। এছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের আয়ের বৈধতা সম্পর্কিত প্রশ্ন উঠতে পারে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

#### ১. প্রযুক্তির ব্যবহার

বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আরও সহজ এবং কম খরচে করা সম্ভব। মোবাইল ব্যাংকিং এবং অন্যান্য ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর খরচ কমানো যেতে পারে। 

#### ২. সরকারের নীতিমালা

সরকারি নীতিমালা এবং প্রণোদনা দেওয়া উচিত, যাতে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত হন। এছাড়া, অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে যে সকল নিয়ম এবং ফি আরোপ করা হয়, তা যথাসম্ভব কম রাখা উচিত। 

#### ৩. বিনিয়োগের সুযোগ

প্রবাসীদের আয়ের একটি বড় অংশ যদি দেশীয় উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যায়, তবে তা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের উচিত প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা, যাতে তারা তাদের প্রেরিত অর্থ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে।


### উপসংহার

প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রভাব সার্বিকভাবে সমাজ ও অর্থনীতিতে পরিলক্ষিত হয়। তবে, এটি কেবলমাত্র একটি সাময়িক সমাধান হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সম্প্রসারণ। প্রবাসী-প্রেরিত অর্থের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে একটি দেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।

  আরও পড়ুন >>> ভালোবাসা অর্থ কি

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url